২০২০ সালের জানুয়ারী মাসের ২৮, ২৯ ও ৩০ তারিখ আমি সিলেট বিভাগের সাতছড়ি ও মৌলভিবাজার জেলায় পাখি দেখতে গিয়েছিলাম। আরও দুইজনের সাথে যাবার সময় একত্রে গেলেও তারা একদিন থেকেই চলে আসেন। আমি বাকি দুইদিন একা একা বেশ কয়েকটি লোকেশানে যাই। বন, হাওড় ও ঘাসবন এই তিন প্রতিবেশে পাখি দেখি ফলে তিনদিনে সর্বমোট ১৫৩ প্রজাতির পাখি দেখতে পেয়েছিলাম। যার মধ্যে ৪০টিরও বেশী পাখি ছিলো আমার জন্য নতুন প্রজাতি। সে এক স্মরনীয় সফর।
ঢাকা থেকে আমরা তিনজন বাসে করে হবিগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রাত আড়াইটার দিকেই হোটেল ব্রাহ্মনবাড়িয়ার হোটেল হাইওয়ে ইন এ যাত্রা বিরতি দেয়, এখান থেকে সাতছড়ি কাছেই তাই আমরা এখানেই নেমে যাই এবং নাস্তা করে নেই। এরপরে সেই রাতেই একটি সিএনজি ভাড়া করে সাতছড়ি বনের দিকে রওনা দেই এবং কনকনে ঠান্ডার মধ্যে রাত সাড়ে তিনটায় সেখানে পৌছই। সবকিছু বন্ধ থাকায় আমরা সাতছড়ির ভেতরে ঢুকে যাই এবং টাওয়ারে গিয়ে উঠি। সিদ্ধান্ত হয় যে এখানে বসেই আমরা বাকি রাত কাটাবো ও ভোরের অপেক্ষায় থাকবো। প্রচন্ড শীত লাগছিলো তাই কাছে যত গরম জামাকাপড় ছিলো সব বের করে গায়ে জড়ালাম এবং ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকলাম কিন্তু ঘুম এলোনা। সাথের দুজন দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমানো শুরু করেছে ততক্ষণে। রাতের নিশুতি অন্ধকারে বনের নিস্তব্ধতা ভেঙে মাঝেমধ্যে কানে আসছিলো শিকরে পেঁচার একটানা ডাক, তক্ষকের ডাক। খুব শান্তিপুর্ন সেই মুহুর্ত্ব। ভোরের কাছাকাছি হয়েছে বুঝতে পারলাম যখন একদুটো মায়াহরিনের ডাক ও থেকে থেকে বনমোরগের কুক্কুরুত কানে আসছিলো। আলো ফোঁটা শুরু হতেই অন্যান্য পাখিরাও আস্তে আস্তে যোগ দেয়া শুরু করলো। বিশেষ করে কানে আসছিলো তিত ছাতারের একটানা টিন টিন টিন টিন ডাক, ফোলা-গলা ছাতারে অসাধারন গান এবং মাঝেমধ্যে এবটের ছাতারের গান। সামনের মান্দার গাছে তখনো ফুল ফোটেনি, একদুটো বের হয়েছে কি হয়নি। তাতেই কেশরী ফিঙে এসে বসে খাচ্ছিলো, এলো একঝাক ফুলমাথা টিয়াও। তবে ছবি তোলার মত ভালো আলো তখনো হয়নি। টাওয়ারে বসেই আমি অনর্গল সবকিছুর ছবি তুলতে থাকলাম কারন বার্ডিং শুরু করার পরে প্রাচুর্যে ভরা বনে এই আমার প্রথম আগমন। ডানে বামে খালি নতুন নতুন পাখি পাচ্ছিলাম।
প্রায় সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত টাওয়ারে থেকে আমরা গেলাম ট্রেইলে, বেশ অনেকখানি হেটে বেশ কিছু পাখি পেলাম, বিশেষ করে উদয়ী পাকড়া ধনেশ পেলাম। এরপরে আবার গেতের কাছে ফিরে টিকিট কাটলাম এবং নাস্তা করে ডর্মিটরিতে রুম নিলাম। এরপর শুকনো খাবার কিনে ব্যাগে ভরে চলে গেলাম ট্রেইলের ভেতরের ছোট পুকুরে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে প্রচুর ছোটপাখি আসে পানি খেতে ও গোসল করতে। তবে অন্ধকার খুব তাই ছবি বেশি ভাল আসেনা, খুব ভালো ক্যামেরা হলে আলাদা কথা। এখানে আমরা অন্ধকার নামা পর্যন্ত থাকলাম এবং আমি আরও বেশ কিছু নতুন পাখি পেলাম। সারাদিনে আমরা ৭০+ প্রজাতির পাখি দেখি এবং আমার প্রায় ২০+ লাইফার হয়। ট্রেইল ধরে হেটে আমরা গেটে ফেরত আসলাম, রাতে হাঁসের গোশত দিয়ে পেটচুক্তি ভুরিভোজ করলাম এবং সঙ্গী দুজনকে বিদায় জানিয়ে ডর্মিটরিতে ঢুকে পড়লাম। ডর্মিটরিতে সেরাতে আমি একাই ছিলাম, বেশ ভয় ভয়ই লেগেছিলো। তবে একঘুমে রাত পার, কিছুই টের পাইনি। সকালে উঠে আরেকবার টাওয়ারে গিয়ে কিছুক্ষন থেকে নেমে এসে খেয়ে রওনা দিলাম পরবর্তী যায়গার উদ্দেশ্যে।
শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে প্রথমে গেলাম শ্রীমঙ্গল এবং এরপরে সিএনজি বুক করে চলে গেলাম বাইক্কা বিল। টিকিট কেটে ঢুকে তো দেখি পাখির ছড়াছড়ি। দ্রুত বেশ কিছু নতুন পাখি পেয়ে গেলাম যার মধ্যে ছিলো বেশ বিপন্ন পালাসী কুড়া ঈগল এবং কালো-লেজ জৌরালি। এছাড়া হাঁস পেলাম বেশ কয়েক রকম। ট্রেইল ধরে সারা দুপুর ও বিকেল হাটলাম ও ছবি তুললাম। সন্ধ্যায় বেরিয়ে সিএনজিতে করে শ্রীমঙ্গলে ফিরে হোটেলে রুম ভাড়া করে দিলাম ঘুম, ও তার আগে বেরিয়ে পানসী হোটেলে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে এসেছিলাম।
পরেরদিন সকালে উঠতে একটু দেরী হয়ে গেল ফলে দ্রুত বেরয়ে বাসে করে চলে গেলাম কমলগঞ্জ এবং গুগল ম্যাপ দেখে দেখে চলে গেলাম এক চা বাগান সংলগ্ন ঘাসবনে যেখানে বেশ কিছু নতুন পাখি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। যায়গাটা খুজে পেতে একটু সময় নষ্ট হল তবে বিকেলের দিকে সেখানে দুরকম চটক আর পাকড়া ঝাড়ফিদ্দা পেলাম যা আমার জন্য নতুন পাখি। এরপরে সন্ধ্যার আগে আগে বাসস্ট্যান্ডের দিকে ফিরতি রওনা দিলাম এবং রাতে খেয়ে বাসে চড়ে বসলাম।
তিনদিনে পাহাড়ি বন, হাওড়/বিল এবং ঘাসবন এই তিন ধরণের প্রতিবেশ কভার করার কারনে মোট ১৫৩ প্রজাতির পাখির সন্ধান পেয়েছিলাম যার মধ্যে ৪৫টি প্রজাতি ছিলো আমার জন্য নতুন।