মুহুরী প্রজেক্টে একদিন – একটি শিকারী পাখিময় দিন (ফেব্রুয়ারী ২০২০)

আমরা একদল সমমনা বার্ডার সিদ্ধান্ত নিলাম যে ফেনীর সোনাগাজীতে অবস্থিত মুহুরী প্রজেক্টে একদিনের জন্য বার্ডিং করতে যাব। যেই কথা সেই কাজ, নয়জনের একটি দল প্রস্তুত হয়ে গেলাম। আয়োজনে ছিলো জিকো ভাই। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের কথা।

রাতে ফার্মগেট এলাকা থেকে আমরা রিজার্ভ করা গাড়িতে উঠে বসলাম এবং রওনা দিলাম। গুলিস্থানের দিক থেকে আরও কয়জন যোগ দিলো। আমরা এগোতে থাকলাম ফেনির দিকে। ফজরের আজানের সময় আমরা কাছাকাছি পৌছে গেলাম। নামাজ পড়ে ফ্রেশ হয়ে আবারও রওনা দিলাম মুহুরীর উদ্দেশ্যে। সেখানে সূর্য ওঠার আগেই পৌছলাম, দারুন এক পরিবেশ সেখানে। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া, মাথার উপর দিয়ে একের পর এক ঝাঁক পাখি সাগরের দিকে উড়ে যাচ্ছে। মাঝিগন তাদের নৌকা নিয়ে আসার সাথে সাথে আমরা চড়ে বসলাম এবং উজানের দিকে দাড় বেয়ে আগাতে থাকলাম। এরকম যায়গায় দাড় বাওয়া নৌকা খুব কার্যকরী কারন শব্দ হয়না ফলে পাখিরা বিরক্ত হয়না। এছাড়া প্রায় পানির লেভেলে থাকা যায় বলে ছবিও ভালো আসে, ইঞ্জিনের ধাক্কার ব্যাপার না থাকায় ছবি কেঁপে ওঠে কম। একমাত্র সমস্যা হল দ্রুত আগান যায়না, তাতে কি আমাদের হাতে সারাদিন সময় রয়েছে।

কিছুদূর আগাতেই আমাদের সামনে পড়লো টিকি হাঁসের ঝাঁক। কাছে ভীড়তে দিচ্ছিলোনা, ক্যামেরার নাগালে আসতে না আসতেই দিচ্ছে উড়াল। এরপরে উড়ন্ত অবস্থায় পেলাম ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস। এছাড়া পাই খয়েরী চখাচখি। এই তিনটিই আমার জন্য নতুন প্রজাতি ছিলো। এছাড়া সেখানে আরও ছিলো ছোট সরালি, জিরিয়া, পিয়াং এবং মরচেরং ভুতিহাস। পানি স্থির হওয়ায় একটু পরপরই কচুরি ও ভাসমান উদ্ভিদ ভাসমান অবস্থায় ছিলো যার মধ্যে পেলাম বেইলনের ক্রেক ও বেশ কিছু ওয়ার্বলার। এছাড়া দেখলাম নেউপিপি আর কালিম। প্রায়ই বসে ছিলো শামুকখোল, বেগুনি ও ধুপনী বক, মাঝারি বক ইত্যাদি। আকাশে একটু পরপরই উড়ে যাচ্ছিলো বড় পানকৌড়ির ঝাঁক, এছাড়া প্রায়ই পাচ্ছিলাম বসা অবস্থায় গয়ারদেরকে। উজানে আসতে আসতে আমরা এমন একযায়গায় আসলাম যেখানে ঘন নলবনের ঠাসবুনোট, পানি বেশি গভীর নয়, নৌকা আগানো মুশকিল। এর মধ্যে ছোট ছোট গাছ হয়েছে। তার একটার উপরে আমরা বসা দেখলাম এক জোড়া বড় চিত্রা ঈগলকে। এছাড়া পাশেই বড় গাছে ছিলো মেটে-মাথা কুড়া ঈগল। নদীর ধারের গাছগুলো বড় পাখিদের বসার যায়গা হিসেবে কাজে দেয়, সেসব চেক করে আমরা আরও পেলাম তুর্কিবাজ, তুরমতি বাজ, বহেরী বাজ এর দেখা। ফেরার সময় পানির উপরে উড়ে উড়ে শিকার করতে দেখলাম পূবের পানকাপাসী ও পাকড়া কাপাসীদেরকে। আর সারাদিনই থেমে থেমে দেখা পাচ্ছিলাম মাছ শিকারের ওস্তাদ মাছমুরালদের। পানিতে হাঁসের সাথে ছিল প্রচুর পরিমানে কালো-মাথা ও ধুসর মাথা গাংচিল, আর চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছিলো প্রচুর জুলফি পানচিল।

বিকেল হয়ে আসায় আমরা ফিরে আসলাম ঘাটের দিকে, কারন ভাটার টানে বাঁধের অপর পাশে পানি নেমে যায় এবং তাতে প্রচুর সোইকতের পাখির দেখা মেলে। সেখানে এসে আমরা দেখা পেলাম টেমিংকের স্টিন্ট, ইউরেশীয় গুলিন্দা, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, তিলা লালপা, পাতি সবুজপাদের। আরও পেলাম বেশ কিছু পাকড়া উল্টোঠুটি, যা আমার জন্য ছিলো নতুন প্রজাতির পাখি।

এরপরে আমরা হেটে উইন্ড টারবাইনগুলোর পেছন দিয়ে মেঠো পথ ধরে হেটে আগাতে থাকি, এখানে খুব কাছ থেকে দেখা পাই একটি দেশি চিত্রা ঈগলের। এছাড়া পেয়েছিলাম কাটুয়া চিল ও ভূবন চিলের দেখাও। শঙ্খচিল ছিল নদীর ওপরে প্রায় সারাদিনই।

সারাদিনে আমরা রেকর্ড পরিমান পাখির দেখা পাই, সকলের তালিকা একত্র করে আমরা ১১০ প্রজাতির বেশি পাখির দেখা পেয়েছি বলে বুঝতে পারি। হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা ফিরতি রওনা দেই এরপরে, একটি হাইওয়ে রেস্তোরায় থেমে ভরপেট খাবার খেয়ে নেই। মাঝরাতের দিকে আমরা সবাই যার যার বাসায় পৌছে যাই ঢাকায়। দিনটি একটি চমৎকার দিন ছিল পাখি দেখার জন্য, আমার মোট ছয় প্রজাতির নতুন পাখি হয়েছিলো মুহুরী প্রজেক্ট থেকে।

পরবর্তীতে ছবি চেক করতে গিয়ে দেখি হাঁসের ঝাঁকের মধ্যে একটি দুর্লভ ফুলুরী হাঁসও ছিলো। কীঈঈঈঈ……

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top