রাজশাহীতে ঝুঁটিয়াল চটক পাওয়া যাচ্ছে, এটা আমার নেই তাই বেশ উশখুশ করছিলাম কয়দিন ধরেই। রাজন ভাইকে বলায় তিনিও যেতে আগ্রহী হলেন, তাই আমি ট্রিপের আয়োজন শুরু করলাম। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার কল্যানপুর থেকে যাত্রা হল শুরু। রাজন ভাই নবীনগর থেকে যোগ দিলেন। বাস একটানা চলে ফজরের আজানের দিকে আমাদের নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে আমরা চলে গেলাম পুলিশ লাইন্স ঘাটে, এখান থেকে লোকাল গাইড নুরু মাঝি আমাদের সাথে যোগ দেবে। তাকে নিয়ে একসাথে আমরা যেখানে আখ খেতে চটক পাওয়া যাচ্ছে সেদিকে রওনা দিলাম। রাস্তা বেশ খারাপ, প্রায় একঘন্টা পরে সেখানে পৌছই এবং খোজাখুজি শুরু করি। আখক্ষেত এর আশেপাশেই আমরা চক্কর দিচ্ছিলাম আর বাইনোকুলার লাগিয়ে স্ক্যান করছিলাম চারপাশ, এর মধ্যে নুরু মাঝি প্রথম একটি পাখিকে স্পট করলো। আমরা তখন তার পিছু নিয়ে কাছে যাবার চেষ্টা শুরু করি। খুব কাছ থেকে তুলতে পারলাম না। এর মধ্যে রাজশাহীর আরও কয়েকজন বার্ডার ভাই-ব্রাদার এসে যোগ দিলেন। এর মধ্যে হঠাৎ খেয়াল করলাম সর্ষে ক্ষেতের ভেতর আরও পাখির নড়াচড়া। ভালো করে চেক করতেই দেখি বেশ কিছু মহা বিপন্ন হলদে-বুক চটক ওড়াউড়ি করছে। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। এই পাখির খবর পেয়ে রাজশাহী থেকে ততক্ষনে আরও বার্ডাররা রওনা দিয়েছে। আমরা তুলতে তুলতে এর মধ্যে পাশে তারের উপরে পেলাম লালচে-কান চটকের দেখাও। মোট তিন রকম চটকের দেখা পাওয়া গেলো, রাজন ভাইয়ের জন্য তিনটাই নতুন, আমার একটা। এরপরে শালিকের ঝাঁকের মধ্যে আমি একটা বিরল ইউরেশীয় শালিক খুজে পেলাম, এবং উপস্থিত সবাইকে ডেকে দেখালাম। অনেকের জন্যই সেটা নতুন পাখি ছিলো।
পরে জানি শালিক মোট দুটো ছিলো সেখানে। আমরা প্রায় এগারোটার দিকে সেখান থেকে চলে আসি এবং নুরু মাঝির বোটে উঠে বসি, গন্তব্য পদ্মার বেশ ভাটিতে সীমান্তবর্তী একটি চর। সেখানে শুনেছি বিজিবির ক্যাম্প রয়েছে এবং যেতে প্রায় দুইঘণ্টা লাগে। আমরা ঘাট থেকেই হালকা রুটি-কলা-বিস্কিট নিয়ে নিয়েছিলাম। তাই খেতে থাকলাম এবং নদীতে হাঁস দেখতে থাকলাম। বেশিরভাগ ছিলো খয়েরী চখাচখি এবং পিয়াং হাঁস, অল্প কিছু সিঁথিহাঁসও ছিলো, সাথে ছিলো কয়েকটি লাল-ঝুঁটি ভুতিহাঁস। আমরা একসময় গিয়ে সেই চরে পৌছাই। এর আগে পদ্মার অনেক চরেই গিয়েছি বেশ কিছু জেলায় কিন্তু এই চরটি বেশ আলাদা মনে হল। খটখটে শুকনো, ঘাস প্রায় নেই বললেই চলে। আর একটু পরপরই বাবলা, কুল জাতীয় কাটাগাছ, মাঝেমধ্যে শিমুলগাছও রয়েছে। দূরে কিছু রোপন করা বাগান জাতীয় দেখা যাচ্ছিলো।
এখানে নেমেই শুরুতে আমরা পেয়ে গেলাম বেশ কিছু সাদা-চোখ তিশাবাজ এর। উড়াউড়ি ও ডাকাডাকি করছিলো, আমরা বেশ ভালো ছবি পাই। এছাড়া এই চরে দেখলাম গরুর বাথান এর আশেপাশে এবং উচু নিচু জমির কাটাঝোপের আশেপাশে প্রচুর ধুসর তিতির পাখি রয়েছে, কাছে যেতে চাইলেই লম্বা উড়াল দিয়ে দূরে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো। আমার ছবি ছিলোনা তাই বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম।
এখানে মূলত পাতি ছাতারের খোঁজ করছিলাম আমরা, কিছুদিন আগেও দেখা গেছে এবং মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। তবে আমাদের কপাল খারাপ, বিরল ছাতারেটির দেখা পেলাম না। বিকেল নেমে আসতে আসতে আমরা ক্লান্ত হয়ে ফিরতি যাত্রা করার উপক্রম করেছি, এমন সময় সঙ্গী কয়েকজন ভারত সীমানা এলাকায় বুনো খরগোশ দেখলো আর ছবি তুলল। আমি দূরে থাকায় দেখতে পাইনি, ধুরু।
ফেরার সময় বেশ কয়েকটি বুটপা ঈগলের দেখা পেলাম ওড়াউড়ি করছে, এছাড়া ঘাটের পাশেই ছিল তিলা লালপা। আমরা বোটে চেপে ফিরতি রওনা দিলাম এবং কাছাকাছি এক ঘাটে নেমে অটোতে করে বাসস্ট্যান্ড চলে আসলাম সবার থেকে বিদায় নিয়ে। কাউণ্টারে এসে টিকিট পেয়ে গেলাম, কেটে পাশেই পেটভরে ভাত খেয়ে নিলাম এবং বাসে চড়ে বসলাম। মাঝরাতের দিকে বাসায় পৌছেছিলাম।
বাসে বসে বসে দেখি আমরা যেখানে চটক তুলেছিলাম তার কাছেই একজন ধুসর-ডানা কালোদামা তুলেছে। বেশ কয়েকদিন ছিল সেটা সেখানে, দলে দলে সবাই গিয়ে তুললো কিন্তু আমার আর রাজন ভাইয়ের আর যাওয়া হয়নি। পরে অবশ্য ভারতে গিয়ে এই দামার ছবি আমি পেয়েছিলাম, তবে সেটা অন্য গল্প।
সারাদিনে আমার একটি নতুন পাখি হয়েছিলো, রাজন ভাইয়ের হয়েছিলো কমপক্ষে পাঁচটা। ধুসর তিতির আর তিশাবাজ এর ছবি পেয়েছি আগের চেয়ে ভালো, রেকর্ড করেছি ডাকও। দিনটি খারাপ ছিল না।