গত আটই সেপ্টেম্বর শুক্রবার আমরা পাখি দেখার ও ছবি তোলার জন্য গিয়েছিলাম মৌলভিবাজার জেলার কমলগঞ্জের রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টে। ঢাকা থেকে দুজন গাইড সহ আটজন গেস্ট বার্ডার আমরা একটি হায়েস মাইক্রো রিজার্ভ করি। বৃহস্পতিবার রাতে আমরা ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে আমাদের অতিথিদেরকে তুলে নেই এবং চলা শুরু করি, ফজরের আগেই আমরা শ্রীমংগল পৌছে যাই। সেখানের বিখ্যাত পানসী হোটেলে ফ্রেশ হয়ে, পাশের মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে ডিম-খিচুড়ি-চিকেন-সবজি দিয়ে নাশতা করে আমরা আমাদের গন্তব্যে আবার রওনা দেই। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো আর আকাশে বেশ মেঘ ছিলো, তবে সুর্যোদয়ের পরপরই খেয়াল করলাম সূর্য উকি দেয়া শুরু করেছে। রাস্তায় একযায়গায় থেমে চা খেয়ে নিয়ে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌছাই।
লোকাল গাইড সাহেব আমাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, সংরক্ষিত বনে ঢোকার জন্য আলাদাভাবে অনুমতি নিতে হয় এবং লোকাল গাইড নেয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়া বর্তমানে বন বিভাগকে একটি নির্দিষ্ট রেভিনিউও পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমরা স্পটে পৌছেই গাইডকে নিয়ে বনে ঢুকে গেলাম এবং সারি বেঁধে হেটে আগাতে থাকি।
বৃষ্টি তখন আর হচ্ছেনা তবে বন ভেজা ছিলো বেশ, অনেকটা যাবার পরে আস্তে আস্তে আশেপাশে পাখির নড়াচড়া টের পাচ্ছিলাম। গাইড চাচা একযায়গায় গিইয়ে বললেন এখানে ট্রগন থাকে, আমরা যেন রেকর্ড করা ডাক বাজাই। ডাক বাজাতেই অল্পক্ষনেই আমরা উচু গাছের মাথায় পাতার আড়ালে লাল রঙ এর মহা সুন্দর পাখিটির উপস্থিতি ও নড়াচড়া লক্ষ্য করলাম। সকলেই লেগে গেলো তার ছবি তোলার চেষ্টায়, তবে পাখিটি খুবই লাজুক ও অস্থির, আমাদের সুযোগই দিচ্ছিলোনা।
এরমধ্যে পাশে দেখা গেলো কালো দৈত্যাকার কাঠবিড়ালি, যেটা আমাদের দেশের শুধুমাত্র কয়েকটি বনেই দেখা মেলে। আমি এই প্রথম এই প্রজাতির কাঠবিড়ালি দেখলাম। এছাড়া দেখলাম কমলা-পেট হিমালয়ী কাঠবিড়ালিও। ট্রগনের ছবি তোলার তেমন সুবিধা করতে না পেরে আমরা আরও এগোতে থাকলাম এবং একটি বেশ চওড়া ছড়ার ধারে এসে পড়লাম। এখানে ভালো পাখির এক্টিভিটি আমাদের চোখে ও কানে আসছিলো। দলটি দুইভাগ হয়ে দুদিকে হাটা শুরু হলো।
বনের ভেতর থেকে কানে আসছিলো কালো-গলা টুনিটুনি, ফোলা-গলা ও এবটের ছাতারের ডাক। শুনলাম মালাপেঙ্গার ডাকও। কয়েক ঝলকের জন্য চোখে পড়লো নীল-কান মাছরাঙারও।
আমরা ছড়া ধরে আশেপাশের বিভিন্ন ছোট ট্রেইল ও শাখা ছড়ায় ঘুরছিলাম। জোঁক এর ভয় থাকলেও এবং প্রস্তুতি নিয়ে গেলেও সেদিন আমাদেরকে জোঁক তেমন ধরেইনি বলা যায়, কয়েকবার সামনে পড়েছিলো শুধু।
এরমধ্যে দেখা পেলাম এশীয় নীলপরির। পাতার আড়াল থেকে থেমে থেমে ডাকাডাকি করছিলো বেশ কয়েকটি পাখি। এছাড়া দেখা পেলাম কালো-ঝুটি, কালো-মাথা ও সাদাগ-লা বুলবুলিদের। আরও দেখা পেলাম এই বনে সহজে দেখা পাওয়া যাওয়া মেটে বুলবুলেরও।
থেমে থেমে কয়েকবার ট্রগন ডাক দিচ্ছিলো, আমরা স্পট করার চেষ্টাও করলাম কিন্তু নড়াচড়া লক্ষ্য করলেও গাছের পাতার আড়ালে থাকা ও দ্রুত যায়গা পালটানো পাখিটির ছবি তোলা গেলোনা।
আগে বেশ কয়েকবার এই বনে এলেও এবার শাখা ছড়া ধরে অনেক ভেতরে গিয়েছিলাম আমরা, অনেকটা ভেতরে গিয়ে খেয়াল করলাম বনের ভেতরে প্রচুর গাছ ও ঝোপ কেটে ফেলা হয়েছে। যা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ঐ এলাকায় না যাওয়া ছাড়া। দুপুরে আমাদের ভারী খাবার খাওয়ার সুযোগ ছিলোনা তাই আগে থেকে কিনে নেয়া ফল-ফ্রুট, বিস্কিট, বাদাম, মিষ্টি ইত্যাদি খাচ্ছিলাম।
আমরা হেটে আবার প্রধান বড় ছড়ায় ফিরে আসলাম এবং ইকবাল এইচ. বাবু ভাইয়ের সাথের দলটির সাথে দেখা হলো। তারা জানালেন তারাও ট্রগন বা নীল-কান মাছরাঙার ছবি নিতে পারেননি। তবে উল্লুক পেয়েছেন, এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন পাখির ছবি তুলেছেন ও তুলেছেন বেশ কিছু দুর্লভ প্রজাপতির দেখা।
গ্রুপের কয়েকজন বললেন তারা সকালের ট্রগনের যায়গায় গিয়ে সময় দিতে চান, লোকাল গাইড চাচার সাথে তারা গেলেন, এবং আমরা কয়জন ছড়ায় আরও চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। নীল-কান মাছরাঙ্গার উড়াউড়ি চোখে পড়ছিলো দূর থেকেই তবে কাছে ভীড়তে দিচ্ছিলোনা। এরমধ্যে পেলাম বড় র্যাকেটফিঙে, একদল লাল বানর ইত্যাদি। ছড়া ধরে প্রায় এক কিলোমিটার যাবার পরে আমরা দূর থেকে নীল-কান মাছরাঙার ছবি নিতে সক্ষম হই। তবে রেকর্ড শট, মোটেও ভালো ছবি না।
এরপরে আমরা ফিরে আসি আর কিছু ফুলগাছে ফুলঝুরিদের নড়াচড়া লক্ষয় করে সেখানে সময় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। সিদুরে-পিঠ ফুলঝুরিদের সাথে একটি হলদে-তলা ফুলঝুরির দেখা মিললো এবং আমরা কোনরকম ছবি তুলতে পারলাম। খেয়াল করলাম ততক্ষনে আলো ভয়াবহ কমে গেছে ও আকাশে মেঘের ঘনঘটা। হঠাত জোরে বৃষ্টি শুরু হলো, আমরা দ্রুত প্রধান ছড়ায় ফিরে গাছের নিচে যে যার মত ছাতা-রেইনকোট পরে বৃষ্টি উপভোগ করতে থাকি, আকাশ ভেঙে যেন বৃষ্টি হচ্ছিলো। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই খেয়াল করলাম ছড়ার পানি কাদাগোলা হয়ে গেছে এবং দ্রুত বেশ কিছুটা পানির উচ্চতা বেড়ে গেলো। আধা ঘন্টার বেশি বৃষ্টি হবার পরে থেমে গেলো, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বিকেল বেলার জন্য আরেকবার আমরা ফুলঝুরির চেষ্টা করবো। সেই গাছের নিচে গিয়ে খুজতে থাকলাম কিন্তু এত অন্ধকার পরিবেশ আর পাখিটি অনেকটা উচুতে হওয়ায় সুবিধা করতে পারলাম না আর। ততক্ষনে আবারও বৃষ্টি শুরু, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আজকের মত ক্ষান্ত দিয়ে ফিরতি রওনা দেয়ার।
ট্রগন এর ডাক আরও কয়েকবার শোনা গেলো কিন্তু অন্ধকার পরিবেশে তাকে আর দেখা যায়নি। সকলে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে জোর কদমে একটানা হেটে বনের প্রান্তে চলে আসলাম, আগের গ্রুপটি বৃষ্টি প্রথমবার শুরু হবার পরেই বেরয়ে এসেছেন জানালেন। আমরা টিউবওয়েল এর পানিতে হাত-মুখ, জুতা-প্যান্ট ও পাইয়ের কাদামাটি ধুয়ে গেঞ্জি পালটে নিলাম এবং গাড়ির দিকে আগাতে থাকলাম।
সকলে গাড়ির কাছে পৌছার পরে আমরা শ্রীমঙ্গলের দিকে ফিরতি রওনা দিলাম। পানসী হোটেলে গাড়ি রেখে ফ্রেশ হয়ে আমরা সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। মেন্যুতে ছিলো মাটন/চিকেন-কয়েক রকম ভর্তা-ডাল-সবজি- সাদাভাত/পরোটা। যে যার মত অর্ডার করলেন এবং আমরা ভরপেট খেয়ে নিলাম। আমার কাছে শুটকি ভর্তাটি ও মুরগীর ঝালফ্রাই ভয়াবহ ঝাল লেগেছিলো। ভাত খাওয়া শেষে সবাই দই ও আরেক রাউন্ড চা খেয়ে ফিরতি রওনা দেই।
খুব ভালো ছবি তোলার সুযোগ কারোই হয়নি, মোটাঠুটির দেখাই পাওয়া যায়নি তবুও সবাই মিলে আড্ডা, বনের ভেতর দিয়ে হাটা, ছড়ার পানিতে পা ভিজিয়ে সারাদিন হাটাহাটি ও পাখির খোঁজ করা, নানারকম স্তন্যপায়ী, পাখি, পোকা-মাকড় ও প্রজাপতির দেখা পাওয়া এবং দুপুরের পরে ঝুম বৃষ্টিতে পড়া, চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত পানসী হোটেলে খাওয়া সবকিছু মিলিয়ে চমৎকার একটি দিন কেটেছে সবার।
আমরা একটানা গাড়ি চালিয়ে গত রাতের র্যুটেই সবাইকে তাদের বাসার কাছে বা কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে মাঝরাত নাগাদ বাসায় নিরাপদে পৌছে যাই।
টার্গেট পাখির প্রজাতিঃ
১. লাল-মাথা কুচিকুচি ২. নীলকান মাছরাঙা ৩. খয়েরী-মাথা শুমচা ৪. মেটে বুলবুল ৫. হলদে-তলা ফুলঝুরী ৬. এশীয় নীলপরি ৭. চাঁদি-বুক মোটাঠুটি ৮. সাদা-পেট উহিনা ৯. উদয়ী শাহবুলবুল ১০. লালচে-কপাল ছাতারে ১১. কালো-গলা টুনটুনি ১২. নীল-ডানা হরবোলা ১৩. জলপাই বুলবুল ১৪.
স্তন্যপায়ী দেখা পেয়েছিঃ দৈত্যাকার, কমলা-পেট ও ইরাবতি কাঠবিড়ালি, গেছো ছুঁচো, পাতি শেয়াল, লাল বানর, হুল্লুক, চশমা হনুমান।