নদী ও ঘাসবনের পাখির খোঁজে রাজশাহীতে দুদিন – ডিসেম্বর ২০২৩

ডিসেম্বর মাসের ১৫ ও ১৬ তারীখে আমরা ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে কয়েকজন ফটোগ্রাফার রওনা দেই রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেন, বেশ আধুনিক  ও দ্রুত গতির ট্রেন। তবে আসতে লেট করলো এবং আমাদের প্রায় আলো ফোটার পরে রাজশাহী পৌছে দিলো। আমরা স্টেশানের পাশেই সকালের নাস্তা সেরে অটো যোগে রওনা হয়ে গেলাম ঘাটের উদ্দেশ্যে এবং মাঝিদের সাথে দেখা করে দুইটি ছোট ও মাঝারি বোটে চড়ে বসে যাত্রা শুরু করলাম। রোদ ঝলমল সুন্দর দিন ছিলো। 

বেশ কিছুদূর এগিয়ে প্রথম একটি ফাঁকা চরে পেয়ে গেলাম বেশ কিছু খয়েরী চখাচখি, একটি মাটিতে বসা পেরেগ্রীন শাহীন এবং কিছু বড় পানকৌড়ির ও ধুপনি বকের। এছাড়া চরে ইতস্থত ঘুরে বেড়াচ্ছিলো ছোট নথজিরিয়া ও ছোট চাপাখির মত পাখিরা। 

বেশ কিছুক্ষন ছবি তুলে আমরা আবারও আগাতে থাকলাম এবং একটি বেশ কর্দমাক্ত চরে আবিস্কার করলাম বিরাট ছোট বাবুবাটানের ঝাঁক, সাথে ছিল প্রচুর ছোট ও টেমিংকের চাপাখি, বাটান ও বেশ কয়েকটি পাকড়া উল্টোঠুটি। সবাই কাছ থেকে খুব ভালো ছবি পেলেন। কয়েকজন সাহস করে কাদায় নেমে আগাতে থাকলাম যাতে বাবুবাটানের ভালো ছবি পাওয়া যায় তবে কাদা খুবই নরম ছিলো এবং কয়েকজন হাটু অব্দি ডুবে গিয়ে আটকে গেলো। রিস্ক হয়ে যায় ভেবে আর না এগিয়ে আমরা সবাই থলথলে নরম কাঁদা মাড়িয়ে আবার বোটে এসে চড়লাম। এই পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে গেছিলাম যারা কাঁদায় ডুবেছিলো বেশি। প্যান্ট ও পা ধুয়ে বোট আবারও যাত্রা শুরু করলো। এরমধ্যে পাওয়া গেলো বড় খোঁপা ডুবুরীর দেখা , সবাই ছবি পেলেন, এরা মস্ত চালাক, এক ডুব দিয়ে এরপরে বেশ কয়েকশো ফুট দুরত্বে গিয়ে আবার মাথা তোলে, অনেকসময় চোখের আড়ালে চলে যায়।  

এগোতে এগোতে আমরা আবারও পেয়ে যাই বিশাল একটি খয়েরী চখাচখির ঝাঁক, সাথে ছিলো বেশ কিছু পিয়াং হাঁস। সবাই বেশ ভালো ছবি তুললেন, সূর্যের বিপরিতে ছিলো তারা। রোদ বেশ চড়ে গেছে ততক্ষণে তাই আমরা বেশি না দাঁড়িয়ে একটানা আমাদের গন্তব্যে আগাতে থাকলাম এবং পৌছে গেলাম। পথে এক যায়গায় নদীর ধারেই চাপাখি ও বাটানদের মধ্যে দেখা মিললো ছোট গুলিন্দা বাটানের, এই পাখিটি কমই পাওয়া যায় এবং গ্রুপের প্রায় সবার জন্যই নতুন পাখি ছিলো। 

আমাদের গন্তব্যে পৌছে আমরা বোট থেকে নেমে আগে হাল্কা নাস্তা করে নিলাম এবং সবার কাছে নাস্তা দিয়ে দিলাম যাতে ক্ষুধা পেলে খাওয়া যায়। এই চরে কোনো দোকানপাট নেই, অল্প কিছু গরু-মহিষের বাথান রয়েছে শুধুমাত্র। ডিসেম্বর মাস হওয়ায় মাটি বেশ সবুজ ছিলো, গতবছর মার্চ মাসে এসে খটখটে রুক্ষ দেখেছিলাম। কিছুদূর এগিয়েই আমরা পেয়ে গেলাম বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি তামাটে-পিঠ লাটোরার। সবাই সময় নিলে বেশ ভালো ছবি পেলেন। এছাড়া দেখা মিললো এই চরে বাস করা কয়েকটি সাদা-চোখ তিশাবাজ এর। যাদের সাথে আকাশে পাল্লা দিচ্ছিলো পরিযায়ী পাতি কেস্ট্রেল/বাজ। আরও পেলাম দেশী নীলকন্ঠ। হঠাত হঠাত দূর থেকে ডেকে উঠছিলো ধূসর তিতিরের দল। যাদের দেখার জন্যই আমরা এসেছি। উচু নিচু এবড়ো খেবড়ো শক্ত মাটির চরের মধ্যে জন্মানো কাঁটাঝোপে এদের বাস আর মানুষ দেখলেও দৌড়ে পালায়, বেশি কাছে চলে গেলে খুব জোরে উড়ে দূরে চলে যায়। আমরা একটি ঝাঁকে বেশ কিছু তিতিরের দেখা পেলাম, সবাই দূর থেকে ছবি তুলতে পারলেন। ওরা গিয়ে পালালো ভারতের সীমানার ভেতরে, আমাদের মাঝিরা আমাদের সতর্ক করলো যে আর যাতে আমরা না আগাই, কারন এই চরের অর্ধেক পড়েছে ভারতের সীমানার মধ্যে। আমরা দূর থেকে সীমানা পিলারও দেখতে পেলাম। মাঝিদের দেখানো পথে আমরা হাটতে থাকলাম এবং মাঝে গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিলাম, ব্যাগে থাকা শুকনো খাবার খেলাম। 

বেশ কিছুক্ষন বিশ্রাম নেয়ার পরে আবারও পাখির খোঁজ শুরু, পাওয়া গেল এক ঝাঁক লাল-লতিকা হটিটির, এছাড়া দেখা মিললো দুইটি দেশী মোটাহাটুর, তবে ছবির সুযোগ পাওয়া যায়নি। বাবলা কাটা জাতীয় গাছের মধ্যে ছোট পাখির নড়াচড়া লক্ষ্য করে আমরা পেয়ে গেলাম পাতি চিফচ্যাফ এর। যেটা গ্রুপের অনেকের জন্যই ছিলো নতুন। আমরা খুজছিলাম এই চরে গত কয়েকদিন ধরে পাওয়া যাওয়া বাংলাদেশের বিরল পাখি পাতি ছাতারেদেরকে কিন্তু পাচ্ছিলাম না। ততক্ষনে বিকেল শুরু হয়ে গেছে, সুর্যাস্তের ঘন্টাখানেক আগে আমাদেরকে অবশ্যই রওনা দিতে হবে, অন্ধকারে নদীতে নানা রকম বিপদ আপদের সম্ভাবনা। আকাশে চক্কর মেরে গেলো একটি বুটপা ঈগল আর একটি লম্বা-পা তিশাবাজ।

নুরু মাঝির দিকনির্দেশনা মত আমরা গরুর বাথানগুলোর চারপাশে ঘুরে ঘুরে খুজতে থাকলাম এবং পেলাম কালো গির্দি, মোহনচূড়া ইত্যাদি পাখিদের। ইতি উতি ঘুরে বেড়াচ্ছিলো তিন প্রজাতির তুলিকা ও ঝাড়ভরতেরা। নুরু মাঝি হঠাত ডেকে বললো ভাই অইযে পাতি ছাতারে, আশেপাশে খেয়াল করে দেখেন আরও আছে। মনটা আনন্দে ভরে উঠলো কারন গতবছর এর আশায় এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরেছিলাম, এবার পেলাম। সবাইকে ফোন করে আমার লোকেশানে আসতে বললাম এবং বেশ কিছুক্ষন ঘুরে ঘুরে আমরা সবাই এই পাতি ছাতারের একটি ছোট দলের ছবি নিলাম, ডাক রেকর্ড করলাম। এবার ফিরতি যাত্রার পালা, হঠাত একটি ধূসর তিতিরের বড় ঝাঁকের দেখা মিললো, প্রায় ১০-১২ টি পাখি দৌড়ে ও উড়ে যাচ্ছে দূর দিয়ে। সবাই হামাগুড়ি দিয়ে ও গুড়ি মেরে এগিয়ে কিছুটা কাছে এগিয়ে গিয়ে ছবি নিলেন, সারাদিনের মধ্যে এই ছবিগুলোই ছিলো মানসম্মত। তবে খুব কাছ থেকে নেয়া পোরট্রেট সেদিন হয়নি। ফিরতি পথে চরের পাশ দিয়ে একটি খাড়ির মত তৈরী হয়েছে সেখান এদেখা মিললো নানা ধরণের সৈকতের পাখির। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কালো-মাথা কাস্তেচরা, তিলা লালপা, পাতি সবুজপা, ধূসর জিরিয়া, বিল বাটান, ছোট ও টেমিংকের চাপাখি সব বাবুবাটান, বাটানের ঝাঁক। আমরা নৌকার কাছে ফিরে হাত পা ধুয়ে অবশিষ্ট খাবার খেতে খেতে ফিরতি রওনা শুরু করলাম এবং একটানা চালিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা পরে অন্ধকারের মধ্যে নিরাপদে ঘাটে এসে পৌছলাম। ঘাটে নেমে চা খেয়ে চললাম হোটেলপানে। যার যার রূমে চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে ঘন্টাখানেক পরে বের হলাম রাজশাহী শহর ঘুরে দেখতে এবং ডিনার করতে। বিখ্যাত রহমানিয়া হোটেলে পছন্দমত খাবার দিয়ডীনার করলেন, এবং খেয়ে বেরিয়ে টং দোকান থেকে খেলাম চা। সবাই হোটেলে ফিরে গেলেন ঘুমানোর জন্য।  

পরেরদিন সকালে উঠে আমরা হোটেল থেকে সোজা রওনা দিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে। বিজয় দিবস হওয়ায় প্রচুর র‍্যালি যাচ্ছিলো এবং বিকট শব্দে ভুভুজেলা বাজছিলো। ভয় হচ্ছিলো ক্যাম্পাসের টার্গেট পাখিগুলো পাবো তো? প্রথমেই আমরা পেয়ে গেলাম ক্যাম্পাসের প্রাইম টার্গেট ছোট বন পেঁচার। এই পাখিটিকে বাংলাদেশে এই একটি যায়গাতেই দেখা মেলে এবং এই একটি পাখিই রয়েছে। সবাই সময় নিয়ে বেশ ভালো ছবি তুললেন, এরপরে আমরা গেলাম স্টেডিয়ামের পাশে। সেখানে রেস্তোরা মত রয়েছে একটা, তার আশেপাশে শালিকের দল ভীড় জমায়। তার মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি বামুনি কাঠশালিকের দেখা পেয়ে গেলাম। সবাই বেশ ভালো ছবি পেলেন। এছাড়া পাশের পুকুরের উপরে তারে বসা পাওয়া গেল মেঘহও মাছরাঙা। এখানে আমরা সকালের নাশ্তাও সেরে নিলাম এবং রওনা দিলাম ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে একটি যায়গায় যেখানে বেশ কিছু পুকুর রয়েছে, পানকৌড়ি, কুড়া ঈগল ইত্যাদি পাওয়া যায়। আমরা গিয়েই পেয়ে গেলাম ছট, দেশী ও বড় এই তিন জাতের পানকৌড়ির দেখা। দেশী পানকৌড়িটি বিরল, গ্রুপের অনেকের জন্যই সেটা নতুন পাখি হল। এছাড়া দেখা মিললো কুড়া ঈগল ও নিশিবকের। ফেরার পথে একটি ধূসর বেজির পরিবারের সাথে আমাদের দেখা হয় এবং সবাই ভালো ছবি পেলাম। 

 

এখানের পর্ব শেষ করে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিলো আবারও পদ্মা নদীতে নামা তবে তার আগে সবাই হোটেলে ফিরে চেক আউট করে গুছিয়ে ঘাটে চলে আসলাম। এই কাজে আমাদের একটু দেরী হয়ে গেল ফলে প্রায় মাঝ দুপুরে আমরা আজকের মত নদী বেড়ানো শুরু করলাম। আজকে গন্তব্য হচ্ছে নদীর উজানে, পথ আগাচ্ছিলো আস্তে। পাতি সরালির একটি বড় ঝাঁকের দেখা মিললো এবং মাঝে মধ্যে খয়েরী চখাচখির দেখা মিলছিলো। দুদিনের বার্ডিং এ পরিচিত রাজশাহীর পদ্মার পরিযায়ী হাঁসেদের ঝাকটিকে পেলাম না, হয়তো আরও দূরের কোথায় গিয়ে বসেছে। আমরা যে চরে গেলাম সেখানে নাকি সাইক্সের রাতচরা আর খাটো-কান পেঁচার দেখা মেলে মাঝেমধ্যে। তবে সম্প্রতি দেখা যায়নি। প্রচুর গরু ও রাখালের দল ছিলো, আমরা বেশ কিছু সম্ভাব্য ঝোপমত  চেক করলাম কিন্তু দুটোর কোনোটাই পেলাম না। একটি কাটুয়া চিল বেশ কাছ থেকে সবাই ছবি ও ভিডিও করলেন, এছাড়া দেখা মিললো প্রচুর নাকুটি ও গাং শালিকের। আরও ছিলো লম্বা-পা তিশাবাজ ও কেস্ট্রেলেরা। ফিরতি পথে হঠাত ঘাসঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে ফাঁকা মাঠের ওপর দিয়ে লম্বা লাফ দিয়ে ঝোপে ঢুকে পালালো একটি খরগোশ, যা আমার নিজের জন্য প্রথম দেখার ঘটনা। দুঃখজনকভাবে গ্রুপের মধ্যে আমি সহ আর একজন মাত্র দেখেছিলাম, বাকি সবাই একটু পেছনে থাকায় মিস করলেন। আরও এগিয়ে আমরা শুকনো ছনের বনের মধ্যে এক জোড়া ধূসর তিতিরের দৌড়াদৌড়ি লক্ষ্য করলাম, কিছুক্ষন আগে ডাকও কানে এসেছিলো। আরও কয়েক পা আগাতেই তারা পরপর মাত্র ফুট বিশেক দূর থেকে উড়ে পালালো। ভালো ছবির সুযোগ ছিলোনা। এবার ফেরার পালা, কারন আমাদের ফিরতি ট্রেন ধরতে হবে এবং তার আগে দুপুরের খাবার খেতে হবে। আমরা ঘাটের দিকে আবার ফিরতে থাকলাম, পথে পেয়ে গেলাম হিউমের ভোঁতা-ভরতের একটি ঝাঁককে। সবাই ছবি পেলেন, এবং হাত-পা ধুয়ে নৌকায় চড়ে বসলেন। অল্প সময় পরেই আমরা শহরের ঘাটে এসে পৌছাই, মাঝিদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে স্টেশানের দিকে রওনা দেই। পাশেই বিখ্যাত ডালাস হোটেলে  পছন্দসই খাবার দিয়ে সবাই লাঞ্চ করলেন এবং রিকশায় করে দ্রুত গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। আবারও পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনেই যাত্রা, সবাই বেশ কাহিল ছিলো, অল্প আড্ডা শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। এবং রাত এগারোটা নাগাদ সবাই বাসায় পৌছে যাই। দুদিনে আমরা প্রায় ১১০ প্রজাতির পাখির দেখা পাই। বেশ চমৎকার দুইটি দিন কাটলো রাজশাহীতে, সবাই একাধিক নতুন পাখির দেখা পেয়েছি তাই সবাই বেশ খুশি। 

1 thought on “নদী ও ঘাসবনের পাখির খোঁজে রাজশাহীতে দুদিন – ডিসেম্বর ২০২৩”

  1. Nearly all of whatever you articulate happens to be astonishingly appropriate and that makes me wonder the reason why I hadn’t looked at this in this light previously. This particular article truly did turn the light on for me as far as this topic goes. Nonetheless there is just one issue I am not too comfortable with and whilst I try to reconcile that with the core theme of your point, let me see just what the rest of the visitors have to say.Nicely done.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top