ট্রিপ রিপোর্ট – সুন্দরবন (হারবাড়িয়া ও করমজল) সেপ্টেম্বর ২০২৩

বৃহস্পতিবার রাতে আমরা ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অতিথীদেরকে তুলে নিয়ে রওনা দেই এবং পদ্মা সেতু হয়ে মংলা পৌছাই। মাঝে গোপালগঞ্জের একটি স্থানে বিরতি দিয়েছিলাম। 

ঘাটে পৌছে আমাদের আগে থেকে ঠিক করে রাখা বোটে উঠে পড়লাম সবাই, তখন পুরো ভাটার সময়, মনটা আনন্দিত হয়ে উঠলো যে আমাদের হারবাড়িয়া যাওয়া সহজ হবে, তবে আকাশে ঘন কালো মেঘের আনাগোনা আর ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকানো দেখে ভাবছিলাম এবারের সুন্দরবন ভ্রমণও কি বৃষ্টিতে ভেসে যেতে যাচ্ছে? এখান থেকে রাজশাহীর কয়েক ভাই আমাদের সাথে যোগ দিলেন। তারা আগেরদিন রাতে এসে পৌছেছিলেন।

ফজর নামাজ পড়ে আমরা আমাদের সকালের নাশতা পার্সেল নিয়ে নিয়েছিলাম। বোট একটানা দক্ষিণে চলতে লাগলো নদীর এক ধার ঘেঁষে। বৃষ্টি কিছুটা কমায় আমরা বোটের ছাদে উঠে  এদিক ওদিক দেখতে থাকলাম। একটু দূর দিয়ে উড়ে যেতে দেখলাম কালো-মাথা কাস্তেচরা, নদীর ধারে মরা গাছের গুড়ির উপরে বসা দেখলাম কালো-টুপি মাছরাঙা, সবাই এক্সাইটেড হয়ে ছবি তোলা শুরু করলেন, তবে আলো না থাকায় ভালো ছবি হয়নি। এরপরে হারবাড়ীয়ার কাছে পৌছে আমরা বোটের ছাদে বসেই পরোটা-ডিমভাজি-ডাল-সবজি দিয়ে নাশতা সেরে নিলাম এবং খালে ঢুকে গেলাম। ভাটার কারনে খালের পানি কম ছিলো ফলে আমাদের সুবিধাই হল। 

আমরা খাল ধরে প্রায় দুই কিলো ভেতরে গিয়েছিলাম এবং এরপরে ঘুরিয়ে ফেরত রওনা দেই। উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে পাওয়া গেলো বাদামী-ডানা মাছারাঙা কয়েকটি, সাদা-গলা মাছরাঙা, সাদা-গলা নীল চুটকি, বন খঞ্জনা, ইউরেশীয় পাপিয়া, কালো-ঘাড় বেনেবৌ ইত্যাদি। 

খালের অংশ শেষ করে আমরা চলে আসি হারবাড়ীয়া, এখানে এসে বন বিভাগের গার্ড নিয়ে ও বোট ফী দিয়ে আমরা ট্রেইলে প্রবেশ করলাম। পাখির উপস্থিতি বেশ কমই ছিলো। তবে ট্রেইলে উঠেই আমরা দেখা পেলাম লাল মাছরাঙার, ট্রেইলের রেলিং এর উপরেই বসা ছিলো। গার্ড ভাই পাশে একটা যায়গা দেখালেন যেখান দিয়ে দুদিন আগে বাঘমামা পার হয়েছে, পায়ের ছাপ রয়েছে এখনো। ট্রেইলে আমরা উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে পেলাম আরও ইউরেশীয় পাপিয়া, করুন পাপিয়া কয়েকটি, আরও সাদা-গলা মাছরাঙা ইত্যাদি। এরপরে হারবাড়িয়ার পুকুরপাড়ে বসে ছোট মাছেদের ফুট-স্পা নিয়ে ও পুকুরের মাঝখানের কাঠের ঘরে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এবার আমরা জোয়ার পেলাম, তাহলে আমাদের করমজল যেতে সহজ হবে, আকাশে আলোর অবস্থাও বেশ ভালো ছিলো তখন। বোটের উপরে বসে ঝিমিয়ে নিতে থাকলাম। পথে নদীর ধারে গাছে বসা পেলাম বড় র‍্যাকেটফিঙে, মাছমুরাল ও তিলা নাগ ঈগল। করমজল পৌছে দেখি প্রচুর লোকের উপস্থিতি সেখানে। 

আমরা দ্রুত টিকিট কেটে ট্রেইলে ঢুকে পড়লাম, শুরুতেই ভালো ছবি পাওয়া গেল তিলা নাগ ঈগলের। ট্রেইলে উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে আছে বন খঞ্জনা, তিলা কুটিকুড়ালি, ডোরা-পাখ চুটকি লাটোরা ইত্যাদি। এরমধ্যে একও পশলা ঝুম বৃষ্টি নামলো, আমরা সবাই রেইনকোট পঞ্চো পরে বসে বসে তা উপভোগ করলাম। আর জোয়ারের সময় হওয়ায় ট্রেইলের নিচের বনতল পুরোটাই পানিতে নিমজ্জিত ছিলো। এই অবস্থা এর আগে আমি পাইনি। 

যাহোক বৃষ্টি শেষে আমরা দুপুরের হালকা খাবার শেষ করে আবারও পাখি খুজতে লাগলাম। এরমধ্যে বর্ধিত ট্রেইলের এক যায়গায় এসে দেখা পাওয়া গেলো বিরল এশীয় বামন চিড়িং মাছ এর। যা প্রায় সবার জন্যই নতুন ছিলো আর এই প্রজাতির মাছ দারুন সুন্দর দেখতে আর এদেশে খুব বিরল। শেষ বিকেল পর্যন্ত আমরা ট্রেইলে ছিলাম, শেষ সময়ে পাওয়া গেলো ডোরা-বুক ও বড় কাঠঠোকরা। এছাড়া কালো-কপাল বনমালিও দেখা গেলো তবে সবাই তুলতে পারেননি। সন্ধ্যার আগে ফিরতি রওনা দেয়ার সময় সবাই যখন ব্যাগ গুছিয়ে প্রায় রেডি তখন হঠাত টিকিট কাউন্টারের পাশেই ঘাসের মধ্যে একটি বান্টিং এর দেখা পাওয়া গেলো, সে একমনে খাবার খেয়ে চলেছে। সবাই আবারও ক্যামেরা বের করে ছবি নিলেন এবং এরপর আমরা ফিরতি রওনা দেই। অভিজ্ঞদের দেখিয়ে জানা গেলো পাখিটি একটি বিরল কালো-মাথা চটক। খালের মুখে আবার দেখা পেলাম বাদামী-ডানা মাছরাঙার। ফেরার সময় পথই যেন আগায় না, মংলা ঘাটে পৌছতে বেশ অন্ধকার নেমে আসলো। আমরা এসেই দ্রুত গাড়িতে উঠে ফিরতি রওনা দিলাম। জ্যাম ও ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে খুলনা জিরো পয়েন্ট পৌছতে বেশ সময় লেগে গেল। রাজশাহী ও কুষ্টিয়ার কয়েকজন এখান থেকে আলাদা হয়ে গেলেন, রইলাম আমরা ঢাকাবাসী কয়েকজন। কামরুলে খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় পাশের আরেক বিখ্যাত আল আরাফাত এ আমরা রাতের খাবার খেলাম। মেনুতে ছিলো সাদা ভাত, চুইঝাল দিয়ে গরুর গোশতের ভূনা, সবজি এবং ডাল। সবার শেষে সাতক্ষীরার দই এবং চা। খাওয়া শেষ করে আমরা একটানা না থেমে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেই এবং সাড়ে বারোটা নাগাদ ঢাকায় ঢুকি। আগেরদিনের রুট অনুযায়ী গাড়ি সকলকে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে নামিয়ে দেয়।

আমরা নিয়মিত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একদিন ও একাধিক দিনের ট্রিপ আয়োজন করছি। যাদের সপ্তাহে মাত্র একদিন ছুটি তারাও চাইলে আমাদের সাথে বার্ডিং এ যেতে পারেন। এছাড়া সামনে নভেম্বর মাসের ১০-১১-১২ তারিখে আমাদের তিনদিনের সুন্দরবন ট্রিপ রয়েছে। তাতেও যোগ দিতে পারেন। যোগাযোগ করতে পারেন নিচের নম্বরে

বুকিং এর জন্য ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপে যোগাযোগ করুন প্লীজ

টার্গেট পাখির প্রজাতি যা যা ছিল (বোল্ড করাগুলো আমরা পেয়েছি): 

  • ধলা-পেট সিন্ধু ঈগল
  • ছোট মদনটাক 
  • কালো-টুপি মাছরাঙা
  • বাদামী-ডানা মাছরাঙা
  • লালচে মাছরাঙা
  • নীল-কান মাছরাঙা 
  • তিলা কুটিকুড়ালি
  • পাতি কাঠঠোকরা
  • ডোরা-বুক কাঠঠোকরা
  • কমলা-পেট ফুলঝুরি 
  • বহুরুপী শিকরে ঈগল।
  • পরিযায়ী বিভিন্ন পাখি
  • নদীর ধারের কাদায় বিভিন্ন সৈকতের পাখি

এগুলো সহ আশা করা যায় সারাদিনে ৬০-৭০ প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যাবে। 

দিনশেষে হয়েছিলো মোট ৬১ প্রজাতি। 

টার্গেট বন্যপ্রানী (সবগুলো দেখা পাওয়া নিশ্চিত নয়): 

  • নদীর ডলফিন/শুশুক  
  • রামগদি গুইসাপ 
  • চিত্রা হরিণ
  • মায়া হরিণ 
  • লাল বানর 
  • বিভিন্ন বাহারী মাছ ও কাকড়া। 
আমাদের যাত্রার ম্যাপ, সকাল থেকে দুপুর হারবাড়িয়া, এরপরে করমজল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top